প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বার, ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

হযরত শাহ আলী বোগদাদী (রহ.): বাংলার রূহানি আলোকবর্তিকা

 

 

লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল—মালেকী

 

প্রারম্ভিক পরিচয় ও জিয়ারতের গুরুত্ব

বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র.) ছিলেন একজন সুপরিচিত ধর্মপ্রচারক এবং আল্লাহর অলি। তিনি একশত সঙ্গী নিয়ে বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করেন। প্রথমে তিনি দিল্লীতে কিছু সময় অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে ঢাকার মিরপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেন, যেখানে তাঁর মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও এখানে জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে শতশত নারী—পুরুষ প্রতিদিন পুণ্যার্থে সমাবেশ করেন। হযরত শাহ আলী বোগদাদীর জীবন আমাদের জন্য এক রূহানি দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবনী স্মরণ এবং মাজার জিয়ারত শুধুমাত্র অতীতের ইতিহাস জানার জন্য নয়, বরং রূহের প্রশান্তি, প্রেরণা এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তি জাগানোর এক প্রক্রিয়া। মাজারে ভক্তরা নামাজ ও দোয়ার মাধ্যমে একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন হন, যা আমাদের অন্তরের রূহানি জীবনকে সমৃদ্ধ করে। 

জন্ম ও পূর্বপুরুষ

শাহ আলীর জন্মবিন্দু নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছু মতভেদ থাকলেও সাধারণ ঐকমত্য অনুযায়ী তিনি বাগদাদের ফোরাত নদীর তীরবর্তী একটি কসবাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি হযরত আলী (রাদ্বি.)—এর বংশধর ছিলেন। পূর্বপুরুষরা মদিনায় বসবাস করতেন, এবং শাহ ছৈয়দ সুলতান আলী বাগদাদে এসেই ধর্মপ্রচার ও রূহানি দিশারী হিসেবে পরিচিত হন।

বাংলায় আগমন ও স্থায়ী বসবাস

ঢাকায় আগমনের সময় শাহ আলী বোগদাদী মিরপুরের এক জরাজীর্ণ মসজিদে স্থাপন হন এবং তা নিজের ইবাদত ও রূহানি সাধনার স্থান হিসেবে গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক মতে, শাহ আলী বোগদাদী ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল আমলে ইন্তিকাল করেছেন। তবে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী তিনি মসজিদের ভেতরে চল্লিশ দিনের চিল্লায় বসেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এবং পীর—আউলিয়ার জীবনীতে কাল্পনিক মৃত্যুর কোনো স্থান নেই। লেখক হিসেবে আমার মত অনুযায়ী, শাহ আলী বোগদাদী সাধনা ও রিয়াজতের মাধ্যমে কামেল অলিতে পরিণত হয়ে বাংলায় এসেছিলেন। যেহেতু চিল্লা সাধনার প্রথম ধাপ, তাই মৃত্যুর পূর্বে চিল্লা করা কাল্পনিক; এটি শিশুদের বর্ণমালা শেখার মতো—প্রাথমিক ধাপ পার হওয়ার পর আবার তা শিখতে হবে না। হিজরী ১২২১ সালে মুহম্মদী শাহ দরগা পুনর্নির্মাণ করেন। আজকের শাহ আলী মসজিদ, শাহ আলী থানা ও শাহ আলী মহিলা কলেজ তাঁর নামানুসারে পরিচিত।

ইসলামের দাওয়াত ও তবলীগ

শাহ আলী বোগদাদী ইসলামের দাওয়াত ও তবলীগের জন্য বাগদাদ ত্যাগ করেন। ঢাকার আশেপাশে ইসলাম প্রচার শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি শুধু ধর্মপ্রচারকই নন, সমাজ ও মানুষের রূহানি উন্নয়নের পথপ্রদর্শকও ছিলেন।

শাহ আলী বোগদাদীর বংশধরদের উত্তরাধিকার

ইতিহাসে প্রমাণিত যে, হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র.) যখন বাংলায় আগমন করেন, তাঁর সাথে আগত বংশধরদের মধ্য থেকে কয়েক প্রজন্ম পরে জন্ম নেন বহু সুফি সাধক। এদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ হয়েছেন দু’জন— হযরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী ও হযরত সৈয়দ আমজাদ আলী পাউসারী। হযরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.)—জন্ম ফরিদপুরের গের্দা এলাকায়; মাজার ভারতের মেহেদীবাগে। তাঁর অন্যতম খলিফা সিরাজগঞ্জের হযরত শাহ ইউসুফ আলী এনায়েতপুরী (রহ.) পরবর্তীকালে একটি বিশাল রূহানি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি ধারা হলো— ১. ফরিদপুরের বিশ্ব জাকের মঞ্জিল (আটরশি দরবার), ২. ফরিদপুরের সৈয়দ মাওলানা আবুল ফজল চন্দ্রপুরী (চন্দ্র পাড়া দরবার)। সৈয়দ মাওলানা আমজাদ আলী পাউসারী (রহ.)—জন্ম ঢাকায়; মাজার মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার শেখরনগর ইউনিয়নের মনোরম পাউসার গ্রামে—এক অপূর্ব শান্তি ও সৌন্দর্যে মোড়ানো জনপদে। সবুজের সমারোহ আর পাখির কলতানে ভরা এ গ্রাম যেন আধ্যাত্মিকতার এক চিরন্তন ঠিকানা, যেখানে দুনিয়ার কোলাহল মিলিয়ে যায় আর হৃদয় ছুঁয়ে যায় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি। তিনি তরিকায়ে ক্বদমীয়ার প্রবর্তক, আধ্যাত্মিক সাধনায় গভীর ও সমাজজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাবশালী এক অলি, যিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিসের শিক্ষক হিসেবেও আলোকিত করেছিলেন শিক্ষাঙ্গন। উভয় সাধকের রূহানি শিক্ষক ছিলেন সৈয়দ মাওলানা সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি বর্ধমানী (র.)। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ফতেহ আলী ওয়াইসি ফারসি ভাষার কবি ছিলেন এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হলো দেওয়ানে ওয়াইসি। তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং তাঁর অসংখ্য অনুসারী ভারত ও বিশ্বের নানা প্রান্তে বিস্তৃত।

মাজার ও রূহানি পরিবেশ

বর্তমানে দূরদূরান্ত থেকে শতশত মানুষ রূহানি টানে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর মাজার জিয়ারতে আসে—মনে রাখার মতো প্রশান্তির খোঁজে। এ দৃশ্য যেন সাক্ষ্য দেয় তিনি আল্লাহর প্রিয় এক বান্দা; যার মাজার সংলগ্ন গাছগাছালিতে শতশত পাখি নিরন্তর কিচিরমিচিরে আল্লাহর জিকির করছে, আধ্যাত্মিক পরিবেশকে পূর্ণতা দান করছে। কুরআনের ভাষ্যমতে, আসমান—জমিনের সমস্ত সৃষ্টি সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন, তবে জ্বীন ও মানবজাতির একটি অংশই সে মহাস্রোতে যুক্ত থাকে, যাদের বলা হয় অলি বা বুযুর্গ। আশ্চর্যের বিষয়, ঢাকা শহরে খোলা প্রান্তর, গাছগাছালি থাকলেও সেখানে এই রূহানি সুর—পাখির জিকিরমগ্ন কলতান—শোনা যায় না; যেন কেবল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আঙিনা এমন রহস্যময় প্রশান্তির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

মাদকসেবী মানুষের উপস্থিতি

মাজারের অন্যপাশে ছিন্নমূল কতিপয় মানুষ গাঁজা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন করে, যা রূহানি পরিবেশ নষ্ট করছে। এটি সতর্কবার্তা দেয় যে রূহানি স্থান রক্ষা করা শুধুমাত্র ইবাদত বা প্রার্থনা নয়; সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিকতা অপরিহার্য।

মাজারের ছায়ায় মোরাকাবার অনুভূতি

শাহ আলী (রহ.)—এর মাজারের পাশে বসে যখন আমি মোরাকাবায় নিমগ্ন হই, তখন চারপাশের দুনিয়ার কোলাহল, জীবনের হাহাকার ও জাগতিক চিন্তাগুলো মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। মনে হয় আমি যেন এক অদৃশ্য রহমতের সাগরে ভেসে চলেছি। সেই রহমতের তরঙ্গ নূরনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)—এর পবিত্র সিনা মুবারক হতে শাহ আলী (রহ.)—এর সিনা হয়ে আমার অন্তরের গভীরে প্রবাহিত হচ্ছে। ধ্যানের প্রতিটি মুহূর্তে কায়মনবাক্যে আমি মগ্ন হয়ে পড়ি এক অচেনা অথচ শান্তিময় জগতে, যেখানে ক্বলব নীরবে বলে ওঠে অজানা এক স্বর্গীয় সুর। মনে হয়, আমার ভেতরটা পরম শান্তির আলোয় ভরে গেছে।

 

শিক্ষণীয় বিষয়

শাহ আলী বোগদাদীর জীবন থেকে আমরা নিম্নলিখিত শিক্ষণীয় বিষয় গ্রহণ করতে পারি: ১. দৃঢ় বিশ্বাস ও ধারাবাহিক সাধনা: জীবনে রূহানি উন্নতি ও লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও ধৈর্যের মাধ্যমে, ২. ভক্তি ও জিকিরের গুরুত্ব: নিয়মিত নামাজ ও দোয়া অন্তরকে আলোকিত করে এবং মানুষের রূহানি জীবন সমৃদ্ধ করে, ৩. সাধনা ও উদারতার মাধ্যমে সমাজে প্রেরণা: নিজের সাধনা ও উদার আচরণ সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, ৪. মিলিত প্রার্থনা ও নিয়মিত নামাজ: একসাথে নামাজ ও জিকির জীবনকে নিয়ন্ত্রণ এবং শান্তি প্রদান করে, ৫. রূহানি পরিবেশ রক্ষা: সামাজিক সচেতনতা, নৈতিকতা এবং নিয়মিত নজরদারি রূহানি পরিবেশের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণী বিতান

মাজার কেবল রূহানি প্রেরণার কেন্দ্র নয়; আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নবীন প্রজন্মকে ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে। পাশাপাশি অনেক বিপণী বিতান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলো মাজারের আশেপাশের সমাজ, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে।

 

সমাপনী

হযরত শাহ আলী বোগদাদী (রহ.)—এর জীবন আমাদের জন্য এক চিরন্তন রূহানি দৃষ্টান্ত। তার সাধনা, বিশ্বাস ও ত্যাগ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণা। মাজারে নামাজ ও জিয়ারত রূহের প্রশান্তি জাগায় এবং শেখায় কিভাবে রূহানি সাধনা, নৈতিকতা, শিক্ষা ও সামাজিক সেবার মাধ্যমে জীবনকে পূর্ণতা দেওয়া যায়।

মন্তব্য করুন