
প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বার, ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী:
আমরা আধুনিক সভ্যতার মানুষ। আমরা উন্নত প্রযুক্তি, ব্যাংকিং, শিক্ষা ও বৈশ্বিক যোগাযোগের কথা বলি। কিন্তু কি আমরা জানি—আমাদের চারপাশে এমন মানুষ আছেন, যারা ত্যাগের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন? তারা হলেন আমাদের মসজিদের ইমাম। তারা শুধু নামাজের নেতা নন; তারা সমাজের রূহানী আলোকবর্তিকা, যারা প্রতিটি মহল্লা ও গ্রামের মানুষের হৃদয়ে আলোর রেখা জ্বালান।
ইমামের বেতন ও জীবনসংগ্রাম: একজন ইমামের মাসিক বেতন মাত্র ১৫০০ টাকা। অথচ সংসারে আছে স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ মা। মাসে খাবারের জন্য লাগে কমপক্ষে ৩-৪ হাজার টাকা। কতজন সাহায্যের হাত বাড়ায়? খুব কম। এবং তারা স্বভাবতই মানুষের সদয় দিকেই আশ্রয় নেন।
প্রতিদিন ইমামরা ঘুমান মসজিদের মেঝেতে, অথবা ছোট একটি ঘরে। খাবার জোটে মুসল্লিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। কখনও কেউ আনে। কখনও নিজেই সংগ্রহ করেন। পরিবারের সঙ্গে দেখা হয় খুবই কম। মাসে একদিনও ছুটি মেলে না। অথচ বেসরকারি চাকরিতে নিয়মিত ছুটি, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট—সবই থাকে।
স্বপ্ন ও ত্যাগ: ইমামের জীবনে স্বপ্ন থাকে। ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়া, মানুষকে পথ দেখানো। কিন্তু সেই স্বপ্ন প্রায় সবসময় অপূর্ণ থাকে। প্রতিদিনের খোরাক, বেতন ও সংগ্রামের মধ্যে পড়ে তাদের হৃদয় কষ্টে ভরে। কেউ কি ভাবেন, রাত জেগে কোরআনের আয়াত পড়া, নামাজের জন্য প্রস্তুতি—এ সব কতটা শক্তির খরচ হয়? কেউ কি জানেন, ইমামের ঘুম ও বিশ্রাম কতটা সীমিত?
বাস্তব জীবন ও দায়িত্ব: অনেক মসজিদে পরিষ্কার বাথরুম নেই। মসজিদের ফ্যান, পায়খানা, মেঝে—সবকিছু নিজে পরিষ্কার করতে হয়। অনেক সময় এমন ছোট ছোট দায়িত্বকেও কুড়ি চোখে দেখা হয়। কখনও কখনও কিছু অশালীন বা বেজন্মের সন্তান ইমামকে ধমক দিয়ে বলে—“মসজিদ অপরিষ্কার কেন? ফ্যান, পায়খানা কেন ঠিক নেই?” যেন তিনি একজন সাধারণ চাকরিকে ধমকাচ্ছেন। এভাবে ধমক খেলে ইমামের মন কেঁদে ওঠে।
গভীর রাত হোক, ঝড়-বৃষ্টি হোক, ডাক পড়লেই ইমাম ছুটে আসেন। তিনি কোন আংশিক স্বার্থের জন্য নয়। তিনি শুধুই ইসলামের খেদমতে। আমরা কি তাঁর ত্যাগ বুঝতে পারি? কতজন দেখেন, কতজন অনুভব করেন?
মুহাম্মদ হানিফের উদাহরণ: ইউটিউবার ময়মনসিংহ জেলার মুহাম্মদ হানিফ তাঁর এলাকায় এক অন্ধ ইমামের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই ইমামের বেতন মাত্র ১৫০০ টাকা। সংসারে আছে স্ত্রী, এক সন্তান ও মা। মাসে কমপক্ষে ৩-৪ হাজার টাকা লাগে, যা চলে মানুষের সহযোগিতায়। মুহাম্মদ হানিফ প্রতিনিয়ত এই অন্ধ ইমামকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন, যাতে তিনি কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
সমাজের অগোছালো চাপ: অনেক সময় দেখা যায়, সমাজের এক পক্ষ অন্য পক্ষের সাথে ঝগড়াফসাদের মধ্যে ইমামকে জড়িয়ে বেজ্জুত করে। মাসআলা মাসায়েল নিজের গায়ে পড়লে ইমামকে সুকৌশলে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। এভাবে সমাজের অগোছালো স্বার্থান্বেষী চাপও ইমামের কাজকে কঠিন করে তোলে।
দুঃখজনকভাবে, কুচক্রী মহল ইমামদের জোর করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। কিন্তু একজন ইমামের পরিচয় একটাই—তিনি ইমাম। তাঁর কাজ হলো নামাজ পড়ানো, মানুষের নৈতিক ও রূহানী পথ দেখানো। রাজনৈতিক জঞ্জাল তাঁকে দূরে সরিয়ে দেয়। এটি উচিত নয়।
অতীত ও বর্তমানের সুফি উদাহরণ: অতীতের এবং বর্তমানের সত্যিকার সুফিরা ইমামদের সর্বোচ্চ সম্মানি দেয়, তাদের ত্যাগ ও জীবনকে সম্মান করে। কারণ তারা জানেন, ইমামের কাজ শুধু নামাজ নয়; এটি সমাজের রূহানী শান্তি ও নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তোলে। আলেমগণ নবীজির উত্তরাধিকারী। তারা ইমামের মর্যাদা ও সম্মান বোঝেন, কারণ ইমামরা আলেমদের মতোই মানুষের নৈতিক ও রূহানী উন্নয়নে দীক্ষা দান করেন।
অন্যান্য ধর্মের নেতা ও তুলনা: ইমামদের সম্মান শুধু মুসলিম সমাজের জন্য নয়। অন্যান্য ধর্মেও ধর্মীয় নেতাদের সম্মান করা হয়। হিন্দু মন্দিরের পুরোহিত বা পুজারি, খ্রিস্টধর্মের পাদ্রী বা ফাদার, বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু বা লামা, সিখ ধর্মের গ্রন্থবাহক বা পণ্ডিত—তাঁরাও গুরুর মতো অনুসারীদের রূহানী পথ দেখান। মুসলিম সমাজে ইমামও ঠিক সেই শ্রদ্ধার যোগ্য।
সামাজিক দায়িত্ব ও করণীয়: একটি ছোট মহল্লায় যদি ২০টি পরিবার থাকে, এবং প্রত্যেকে মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করে, তাহলে সহজেই ৬০০০ টাকা সম্মানী জোগাড় করা সম্ভব। কিন্তু আমরা তা করি না। আমাদের চোখে কেবল স্বার্থ। আমাদের হৃদয় ব্যস্ত।
রিযিকের মালিক আল্লাহ। তিনি সর্বোত্তম রিযিকদাতা। তবে আল্লাহ মানুষের হাত দিয়েই মানুষের প্রাপ্য পৌঁছে দেন। ইমামের সম্মান, তাঁর সঠিক বেতন, সামান্য সহানুভূতি—এসবই তার জীবনকে আলোকিত করে।
ইমামের জীবন সহজ নয়। অনেক সময় তার নামাজে একাগ্রতা ভেঙে যায়। অনেক মুসল্লি বুঝতে পারেন না, নামাজের প্রস্তুতিতে কত পরিশ্রম লাগে। ছোট ছোট অসুবিধা, রাত জাগা, সীমিত ঘুম—এসবের মধ্যেও তিনি ইসলাম ও মানুষের খেদমত চালিয়ে যান।
উপসংহার: যারা ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সম্মান করেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দোয়া। আর যারা তাদের অসম্মান করেন, তাদের বিচার বা হেদায়াতের ভার আল্লাহ ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে।
আমরা মানুষ হই। আসুন, চোখে জল নিয়ে ভাবি, হৃদয় ভরে দুঃখ অনুভব করি। ইমামের জন্য অন্তত একটি মানুষের সহানুভূতি। ইমামের জন্য অন্তত একটি মানুষের হৃদয়ের দরজা খোলা। অন্তত একটি মানুষ দয়া ও সম্মান দেখাক।
প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি গ্রামে, আমরা যদি এই ছোট্ট উদ্যোগ করি—ইমামের সম্মান বাড়াই, তাঁর বেতন যোগ করি, মানুষের কাছে তাঁর ত্যাগ তুলে ধরি—তাহলে সমাজের রূহানী আলো বৃদ্ধি পাবে। আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উজ্জীবিত হব। আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। আমাদের সমাজ ন্যায় ও রূহানী শিক্ষায় সমৃদ্ধ হবে।
মন্তব্য করুন