প্রকাশিত: ২৫ আগষ্ট, ২০২৫, ০২:৪৩ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

সুফি মননের সাধক: ডাক্তার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরী

 

 

✍️ কায়ছার উদ্দীন আল—মালেকীঃ

বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে সুফিবাদ শুধু ভক্তি বা সাধনার পথ নয়, বরং জ্ঞান, মানবপ্রেম ও আত্মশুদ্ধির সেতুবন্ধন। এই সেতুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফুরফুরার হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রহ.) ও সুরেশ্বর দরবারের সৈয়দ আহমদ আলী সুরেশ্বরী (রহ.)। তাঁরা দুজন ছিলেন আধ্যাত্মিকভাবে পীরভাই, আর তাঁদের পীর ছিলেন মহান সুফি সৈয়দ শাহ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি বর্ধমানী (রহ.)। এই মহিমান্বিত সিলসিলার এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী হলেন ডাক্তার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরী।

আধ্যাত্মিক বংশ ও সিলসিলা:

ড. জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরীর আধ্যাত্মিক শিকড় দুটি প্রধান ধারার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর পিতা হেলাল সাহেব ছিলেন ফুরফুরার হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রহ.)-এর সিলসিলার অনুসারী। অন্যদিকে, তিনি নিজে সম্পৃক্ত হন সৈয়দ আহমদ আলী সুরেশ্বরী (রহ.)-এর সিলসিলার সঙ্গে। ফলে তাঁর ভেতর গড়ে ওঠে এক দ্বিমুখী আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার—যার এক দিক ফুরফুরা শরীফের নূরানী ধারা, আর অন্য দিক সুরেশ্বর দরবারের প্রজ্ঞা ও সাধনার ধারা। এই মিলিত স্রোতধারাই তাঁর সাধক-জীবনকে করেছে সমৃদ্ধ ও গভীর।

সাধক ও চিকিৎসক:

ডাক্তার জাহাঙ্গীর ছিলেন পেশায় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। রোগীর শরীরের অসুখ সারানোর পাশাপাশি আত্মার রোগ সারানোও ছিল তাঁর সাধনার অংশ। চিকিৎসকের দায়িত্ব ও সাধকের মহব্বত—এই দুই প্রবাহ মিলে তাঁর জীবনকে করেছে অনন্য।

জ্ঞানের ভাণ্ডার:

আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজিসহ বহু ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। ভাষার এই পারদর্শিতা তাঁকে কুরআন-হাদিস, সুফি সাহিত্য ও বিশ্বচিন্তার বিপুল ভাণ্ডারে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। এর ফলেই তিনি সুফিবাদকে আধুনিক চিন্তার আলোয় নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন।

গবেষণা ও রচনা:

ড. জাহাঙ্গীর বহু গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর লেখনীতে সুফি দর্শনের ভেতরকার গভীরতা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এসেছে আধুনিক সময়ের প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের উত্তর। তিনি ছিলেন এক সত্যসন্ধানী মন। তাঁকে ঘিরে যেমন শ্রদ্ধার স্রোত বইয়ে গেছে, তেমনি কিছু সমালোচনাও উঠেছে—কিন্তু একজন সত্যসন্ধানী গবেষকের জীবনে এটি অস্বাভাবিক নয়।

সুফিবাদের আধুনিক পথিকৃৎ:

বাংলার সুফি-চিন্তার ইতিহাসে সদর উদ্দীন চিশতি-এর পর আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুফিবাদকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার কৃতিত্ব যাঁর, তিনি ডাক্তার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরী। তাঁর চিন্তায় আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রেম, মানবসেবা ও সামাজিক কল্যাণ সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি শুধু একজন সাধকই নন—তিনি ছিলেন সমকালীন সুফি-মননের এক আধুনিক পথিকৃৎ।

জন্ম ও শেষ যাত্রা:

ডাক্তার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে। জীবনের সমস্ত সাধনা ও গবেষণার অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি ২০২০ সালের ২৫শে এপ্রিল, রোজ শুক্রবার, বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। মৃত্যুতেও তিনি রেখে গেছেন জ্ঞান, প্রেম ও সেবার উজ্জ্বল উত্তরাধিকার।

উপসংহার

ড. জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরী আমাদের সামনে রেখে গেছেন জ্ঞান, প্রেম ও সেবার যে ধ্রুবতারা, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি গবেষক, সাধক, দার্শনিক এবং চিকিৎসক—সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সুফি-মননের এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জন্মদিনে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি।

মন্তব্য করুন