
প্রকাশিত: ১৭ ঘন্টা আগে, ০৩:৪৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
মো: কাইসার উদ্দিনঃ
লেখক ও ব্যাংকার: কায়ছার উদ্দীন আল মালেকী
বাংলার মাটি বহু জ্ঞানী—আলেম, বহু সাধক—দরবেশ, বহু আল্লাহর প্রিয় বান্দার পদচিহ্নে পবিত্র। তবে তন্মধ্যে কিছুজন থাকেন, যাঁদের অস্তিত্ব একা তাঁদের সমসাময়িক সমাজ নয়—পেরিয়ে যায় প্রজন্মের গণ্ডিও। এমনই এক অনন্য আধ্যাত্মিক মহিরুহ ছিলেন হজরতুল্লাহ শাহ সুফি আহসানুজ্জামান (রহ.)। তিনি ছিলেন আল্লাহর সেই প্রিয় বান্দাদের একজন, যাঁদের নাম কেবল দরবারেই নয়, হৃদয়ের গভীরে উচ্চারিত হয়।
ঢাকার জনপদ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বহু অঞ্চল তাঁকে চিনেছে, ভালোবেসেছে। তাঁর পূর্বসূরি—মশুরীখোলা দরবার শরীফের পীর হজরতুল্লাহ শাহ আহসানুল্লাহ (রহ.) ছিলেন এক আকাশসম বর্ণিল ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে হজরত আহসানুজ্জামান (রহ.) শুধু নাম নয়, ছিলেন এক অনুপম জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি।
প্রথম সাক্ষাৎ: এক সোহবতের নীরব জাগরণ:
২০২১ সালের শেষ প্রান্তে, ঢাকা শহরের কোলাহল ছেড়ে একদিন মশুরীখোলা দরবারে গিয়ে আমার হৃদয় যেন কিছু একটায় বাঁধা পড়ে। সেখানে বসে সুফি আহসানুল্লাহ (রহ.)—এর জীবন নিয়ে গবেষণায় ডুবে থাকতে থাকতে পরিচয় হলো তাঁর উত্তরসূরি, সুফি আহসানুজ্জামান (রহ.)—এর সঙ্গে। তাঁর সামনে বসে, তাঁর কণ্ঠ শুনে, তাঁর দৃষ্টিতে ডুবে গিয়ে মনে হলো—আল্লাহর কোনো প্রিয় বান্দা সামনে বসা। এমন একটি হৃদয়, যা জ্বলছিল আল্লাহর প্রেমে, আর ছড়িয়ে দিচ্ছিল সহমর্মিতার আলো।
সীমার সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এক দরবেশ:
তিনি পীর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল না দরবারের চৌহদ্দিতে। তাঁর খেদমতের পরিধি ছিল আকাশছোঁয়া। হাজারো ক্ষুধার্তকে তিনি ইফতার করাতেন, এতিম শিশুদের শিক্ষার ভার নিতেন, গড়তেন মাদ্রাসা—মসজিদ—মক্তব—আর তাতেই গড়ে উঠত এক একটি সভ্যতার মৌলিক স্তম্ভ।
তাঁর চিন্তা ছিল স্বচ্ছ, তাঁর সাহস ছিল বলিষ্ঠ। তিনি প্রতিবাদ করতেন রাষ্ট্রবিরোধী বা ধর্মদ্রোহী কোনো কার্যক্রমে, আবার একাই দাঁড়িয়ে যেতেন নিপীড়িতদের পক্ষে। সুফিবাদের যে একটি প্রান্ত থাকে পরম সহিষ্ণুতা ও করুণা, তাঁর চরিত্রে সেটি ছিল হৃদয়ের গভীরে গাঁথা।
সাদামাটা জীবন, সাহসিকতার দীপ্তি:
অর্থে—প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ হলেও, তিনি বেছে নিয়েছিলেন এক সাদাসিধে জীবন। অল্প আহার, অল্প বাক্য, বেশি নামাজ আর অসংখ্য সিজদা—সেটাই ছিল তাঁর দৈনন্দিন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। রাতের এশার পর দীর্ঘ সময় আল্লাহর দরবারে বসে থাকতেন—কখনো নীরব চোখে, কখনো জলে ভেজা সিজদায়।
শেষ সন্ধ্যার শোকনদী
গতকাল ঠিক দুপুর ১২টায়, তিনি পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। অথচ মনে হলো, তিনি যেন হারিয়ে যাননি, বরং নিরবে এক ঘর ছেড়ে আরেক ঘরে চলে গেছেন। আজ সকাল ৮টায় যখন তাঁর দেহ মুবারক দেখতে গেলাম, দেখলাম—তাঁর চেহারায় জ্বলজ্বল করছে এক নূর, এক আধ্যাত্মিক দীপ্তি।
গত ২৪ ঘণ্টা পার হলেও, অবাক হয়ে দেখলাম—ফ্রিজ ছাড়াই দীর্ঘ সময় পরও তাঁর দেহ নরম, চেহারায় এক অপার্থিব নূরানিয়ত। চেহারা যেন আলো ছড়াচ্ছে, হিমশীতল নয়—নরম, কোমল, প্রশান্ত। মানুষের ভিড়, অশ্রুজল, নিস্তব্ধ গাছপালা—সবকিছু যেন শোকে বিভোর।
খেলাফত ও খেদমতের গৌরব:
তিনি ছিলেন কাদেরিয়া ও চিশতিয়া—এই দুটি সুপ্রাচীন তরিকতের খেলাফতপ্রাপ্ত। বিশেষ করে চিশতিয়া সিলসিলা, যা সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)—এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সে তরিকতের গভীরতা তাঁর জীবনেও ছিল প্রতিফলিত।
তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিশ্বস্ত একজন আলোকবর্তিকা ছিলেন। রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক—ঢাকা কেন্দ্রীক সব কর্মসূচিতে তিনি দরবার খুলে দিতেন কর্মীদের জন্য। বহু মানুষ এসে বিনামূল্যে আশ্রয় পেতেন, আহার করতেন, হৃদয় পেতেন। এই মেহমানদারিতাই ছিল তাঁর আরেকটি অলৌকিক গুণ।
আজ মশুরীখোলা দরবারের গাছপালাও যেন নীরব। আকাশ অঝোরে কাঁদে মাঝে মাঝে। এমনকি প্রকৃতিও আজ কেমন ঘোমটা টেনে বসে আছে।
“মাউতুল আলিমে কা মাউতুল আলম”
একজন আলেমের মৃত্যু মানে শুধু একজন মানুষের না থাকা নয়—এ যেন একটি যুগের, একটি আলোর, একটি ইতিহাসের পর্দা নামা।
অনেকে বলে, ওলিরা মরে গেলে শরীর পচে যায়। কিন্তু আমি নিজ চোখে দেখলাম—এতক্ষণেও তাঁর শরীর অক্ষত, জ্বলজ্বল করছে। ওলিরা মরেন না, তারা নিঃশব্দে আল্লাহর চূড়ান্ত সান্নিধ্যে চলে যান।
ওলিরা মরেন না—আল্লাহর ঘোষণা ও রাসূলের বাণী:
কুরআনের ঘোষণা, “যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না। বরং তারা জীবিত, তারা তাদের রবের কাছে রিজিক পায়”-সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৯)।
হাদীস শরীফ এসেছে, “আল্লাহর ওলিরা মরে না, বরং তাঁরা কেবল এক ঘর (দুনিয়া) থেকে আরেক ঘরে (আখিরাত) চলে যান।”
সমাপ্তি
হজরতুল্লাহ শাহ সুফি আহসানুজ্জামান (রহ.) চলে গেছেন—ঠিক।
কিন্তু তিনি হারিয়ে যাননি।
তিনি ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন—
প্রত্যেকটি সেই হৃদয়ে,
যেখানে এখনো কোনো সিজদার অশ্রু পড়ে।
মন্তব্য করুন