
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই, ২০২৪, ০৬:১১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্বের যেসব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি, সেখানে দারিদ্র্যের হারও বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি খাত। এরপরে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মাতৃস্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস। জলবায়ু পরিবর্তনে শস্য ক্যালেন্ডার বদলে গেছে। যে ফসল যে সময়ে ঘরে ওঠার কথা, সেটা উঠছে না। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যাÑ এমন নানা কিছু ঘটছে। লবণাক্ততার সমস্যা আছে। বাংলাদেশে গড় বৃষ্টিপাত কমেনি। কিন্তু বৃষ্টি যখন শুরু হওয়ার কথা, এর দৈর্ঘ্য যেমন হওয়ার কথা তেমনটা হচ্ছে না। দু-তিন দিনে হয়তো মাসখানেকের সমান বৃষ্টি হচ্ছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত মৃত্যু সবচেয়ে বেশি খুলনা অঞ্চলে। দেশের ৩৫টি জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁঁকিতে আছে। বছর দশেকের মধ্যে দেশের বড় একটা অংশের মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগবে। এখানে পানির সংকটটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবন বা আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা, বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা, পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির তীব্র সংকট। এসব অঞ্চলে মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না, চাষাবাদের পানি নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত। ২০৪৭ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশ পানির নিচে চলে যাবে। নীরব বাস্তুচ্যুতি চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ঢাকার বস্তিগুলোতে বাস্তুচ্যুত ৬৩ শতাংশ মানুষ ১০ জেলা থেকে এসেছে। সবাই ঢাকায় আসবে, এমনটা নয়। সাতক্ষীরার লোকজন খুলনায়, ভোলার লোকজন হয়তো বরিশালে যাবে। মানুষ তো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁঁকি মোকাবিলা করেই বেঁচে আছে। তাঁদের ফল ও ফসল নষ্ট হচ্ছে, তাঁরা পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছে না।
ডব্লিউএফপি চলতি মাসে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত খাদ্য পরিস্থিতির পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংকটের সময় বাংলাদেশে খাদ্য ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে। কোভিড-১৯ সংকটের পর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে খাদ্য আমদানি কমে আসে। এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য এবং গবাদিপশুর উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। সংকট শুরু হওয়ার পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে খাদ্যের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এর মধ্যে শক্তি জোগায় এমন খাদ্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। চাল-গমের মতো দানাদার খাদ্য, চিনি, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস-মুরগির মতো প্রাণিজ আমিষ ও সবজি, দুধ ও ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবারের দামও বেড়ে যায়।
ডব্লিউএফপির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৮ শতাংশে পৌঁছায়। এর আগে ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২৩ সাল থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। ওই বছরের অক্টোবরে তা ১৩ শতাংশে পৌঁছায়। সংকট শুরু হওয়ার পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে খাদ্যের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এর মধ্যে শক্তি জোগায় এমন খাদ্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। চাল ও গমের মতো দানাদার খাদ্য, চিনি, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস ও মুরগির মতো প্রাণিজ আমিষ ও সবজি, দুধ ও ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবারের দামও বেড়ে যায়।
কোভিড-১৯ মহামারি, দৈনন্দিন ব্যয় বৃদ্ধি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত তিন বছরে বিশ্বজুড়ে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এমন তথ্য জানিয়েছে। আর এ সংকট থেকে সাধারণ মানুষদের রক্ষায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম সাময়িক স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। দিনে যাদের আয় ২.১৫ মার্কিন ডলারেরও (২৩৩ টাকা) কম। এ ছাড়া নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ কোটি (দিনে যাদের আয় ৩.৬৫ ডলার বা ৩৯৫ টাকার বেশি নয়। এতে বলা হয়, সবচেয়ে দরিদ্র মানুষই উল্লিখিত অভিঘাতের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২৩ সাল শেষেও এসব মানুষ কোভিড-১৯ মহামারির আগে তাদের আয়ের অবস্থায় ফিরতে পারেনি।
ইউএনডিপির প্রধান আখিম স্টেইনার জানান, তিন বছর ধরে যেসব দেশ সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করেছে সেসব দেশ বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমায় অবনমন থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। তিনি জানান, তুলনামূলকভাবে উচ্চমাত্রায় ঋণগ্রস্ত দেশগুলো তাদের জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা খাতে ততটা ব্যয় করতে পারেনি। কারণ উচ্চমাত্রায় ঋণের সঙ্গে সামাজিক খাতে অপ্রতুল অর্থ ব্যয়ের একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই উচ্চ মাত্রায় ঋণগ্রস্ত দেশগুলোতে নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়া জনগোষ্ঠীর হার আশঙ্কাজনক বেশি। জাতিসংঘের প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন মানুষ যেটা বিশ্বের মোট মানবগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকÑ এমন দেশসমূহে বসবাস করে যেসব দেশ বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে, তার চেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখে তাদের ঋণ পরিশোধে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন করে দরিদ্র হওয়া সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে সচ্ছল করতে বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হবে। যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ০.০০০৯ ভাগ। তবে তাদের অবস্থা পুরোপুরি খারাপ হওয়ার আগে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে এতে ১০৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে, যা বিশ্ব জিডিপির ০.০৬৫ ভাগ। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার নিন্দা করেছেন। তার মতে, বর্তমানে প্রচলিত সেকেলে আর্থিক ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শক্তির গতিশীলতাকে তুলে ধরছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যা, খরা, সামুদ্রিক ঝড়, ভূমিধস এবং দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি মাত্রায় এসবের শিকার হচ্ছে তারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছে এটি মোকাবিলায় তাদের অর্থ দরকার। এটিকেই বলা হচ্ছে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ।’ এর আওতায় বাড়িঘর, জমি, খামার, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতি, মানুষের মৃত্যু, সাংস্কৃতিক এলাকা বা প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মতো বিষযগুলোও।
ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য দরিদ্রতর দেশগুলোকে বছরে ১০০০০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে। মূলত দুটি ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেওয়া হবে। একটি হলো মিটিগেশন বা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, আরেকটি হচ্ছে অ্যাডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য নেওয়া পদক্ষেপ। তবে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজে’র আওতায় যে অর্থ সহায়তার কথা বলা হচ্ছে তা এর অতিরিক্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১০০ জনেরও বেশি গবেষক ও নীতিনির্ধারকের একটি গোষ্ঠী হচ্ছে, ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ কোলাবোরেশন’।
তারা তাদের এক নতুন রিপোর্টে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপদাপন্ন ৫৫টি দেশে ইতোমধ্যেই (২০০০-২০ পর্যন্ত) যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ হচ্ছে ৫০,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আগামী দশকে এ ক্ষতি আরও ৫০,০০০ কোটি ডলার বেড়ে যাবে।
রিপোর্ট প্রণেতারা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এক ভগ্নাংশ পরিমাণ বাড়ার অর্থ হচ্ছে আরও ক্ষতি, আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৯০০০ কোটি ডলার থেকে ৫৮০০০ কোটি ডলার পর্যন্ত।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা এখন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চাইতে ১.১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেছে। দরিদ্র এবং কম শিল্পোন্নত দেশগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম আবহাওয়ার কারণে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, তারা ক্ষতি কাটাতে গিয়ে আরও বেশি করে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে।
যুদ্ধ চলতে থাকলে আরও ৫ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে
দশম মাসে গড়াল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের যুদ্ধ। এতে ফিলিস্তিনে দারিদ্র্যের হার ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আরও ৫ লাখের বেশি লোক দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে। জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে এ কথা আগেই জানিয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৮.৪ শতাংশ কমে যাবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং পশ্চিম এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইএসসিডব্লিউএ) প্রাথমিক অনুমিত হিসাব অনুসারে এই ক্ষতির পরিমাণ ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। দুটি সংস্থা ফিলিস্তিনের গাজা যুদ্ধের আর্থ-সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, গাজা যুদ্ধের এক মাসে দারিদ্র্য ২০ শতাংশ বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
মূল্যায়নে আরও জোর দেওয়া হয় যে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা অনুমান করে যে, যুদ্ধের প্রথম মাসে ইতোমধ্যে ৩ লাখ ৯০ হাজার লোক চাকরি হারিয়েছে। অনুমান অনুসারে, যুদ্ধের তৃতীয় মাসে দারিদ্র্য প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যাতে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া অতিরিক্ত লোকের সংখ্যা ৬ লাখ ৬০ হাজারের বেশি বৃদ্ধি পাবে। এতে মোট ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষতির সাথে জিডিপি হ্রাস পাবে ১২.২ শতাংশ।
১০ বছরে দরিদ্র হবে আরও ২০ কোটি মানুষ
করোনাভাইরাস মহামারির দীর্ঘকালীন প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। এ কারণে আগামী দশ বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে আরও ২০ কোটির বেশি মানুষ। জাতিসংঘ এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা একশ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। করোনা মহামারির কারণে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া সাধারণ মানুষ। আগামী এক দশকে ব্যাপক হারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। না খেতে পেয়ে দিন কাটাতে হবে বহু মানুষকে। জাতিসংঘের নতুন এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী দশ বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আরও ২০৭ মিলিয়ন বা ২০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। সারাবিশ্বেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে করোনা ভাইরাস। বিভিন্ন দেশের আর্থিক অগ্রগতি থমকে গেছে। কাজ হারিয়েছে বহু মানুষ। সেভাবে নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন দেশের আর্থিক বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন থমকে গেছে।
সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন