
প্রকাশিত: ১৮ ঘন্টা আগে, ১১:০৬ এ এম
অনলাইন সংস্করণ
সদরুল আইনঃ
শিক্ষার্থী সংকটে রাজধানীর ৩৪১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সারাদেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
ঢাকা মহানগরীতে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের ১৬ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ লাখই পড়ালেখা করছে বেসরকারিতে। শিক্ষকরাও তাদের সন্তানদের ‘গরিবের বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি করছেন না।
অনেক সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ছুটির দিনে বিয়ে-সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে। আর এটা নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।
শিক্ষাবিদরা বলেন, সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার পেছনেই দেদারছে টাকা ঢালতে হচ্ছে অভিভাবকদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ধনী, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরাও প্রাথমিক শিক্ষায় বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করছেন।
সেক্ষেত্রে ধনী অভিভাবকদের জন্যও বিষয়টি কষ্টকর না হলেও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে। আর নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা এখন কঠিন এক বাস্তবতা। বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন।
শিক্ষার্থী কম থাকা ৩০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পাশের বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
‘মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করি, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশ জুড়ে গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৫’। সকালে রাজধানীর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা লালনের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। দুই মন্ত্রণালয়ে আমাদের এমন কিছু কাজ করা প্রয়োজন, যাতে আজকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেল তাদের এই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করা।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সীমিত সম্পদ, সরকারে আমাদের সীমিত সময় ও সুযোগের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সকলকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের যথাযথ সম্মানী দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে যা যা করণীয় তা বর্তমান সরকার করে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, দেশের ৩২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। শিক্ষকদের নামে যেনতেনভাবে মামলা দেওয়ায় স্কুল পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, বাণিজ্যিকীকরণের কারণে শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। অনেকেই জিপিএ ফাইভ পায় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করতে পারছে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বই ছাপা ও বিলি করার দায়িত্ব চান অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
কর্মচারীদের সমান উৎসব ভাতা পেতে যাচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরাকর্মচারীদের সমান উৎসব ভাতা পেতে যাচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরা
তার মতে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শুধু শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত থাকবে।
আলোচনাসভা শেষে বিজয়ীদের মাঝে প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০২৪ প্রদান করা হয়। এবার দেশের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
আর শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক বগুড়ার গাবতলীর পদ্মপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল এবং শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষিকা হয়েছেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শিউলি সুলতানা। এর মানে হলো শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়, শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষিকা—সবাই উত্তরাঞ্চলের।
‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ’ উপলক্ষে এবার ১৪টি শ্রেণিতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এবং শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিষয়ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার ১৮টি শ্রেণিতে (বালক ও বালিকা) প্রথম স্থান অধিকারীদের পুরস্কার দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ।
শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিষয়ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অনুযায়ী বিজয়ীদের ১৮টি শ্রেণিতে (বালক ও বালিকা) মোট ১০৮টি পুরস্কার এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৪টি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অনুযায়ী ৪২টি পুরস্কারসহ মোট ১৫০টি পুরস্কার দেওয়া হয়।
দেশ জুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল বিনা মূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। প্রায় প্রতিটি জেলায়ই প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এসব বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে।
প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এখানেই। ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা। প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ঢাকায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৯০৭ জন।
তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ৪৫ হাজার ৪১৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৩।
তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে এখানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ দশমিক ৬ শতাংশ পড়াশোনা করছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তাব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের অনীহার কারণেই ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা কম ভর্তি হচ্ছে।
টানা কদিন প্রাথমিক শিক্ষার হালচাল সম্পর্কে সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন শুধুই গরিবের স্কুলে পরিণত হয়েছে।
১৭ ও ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ১৭ ও ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়ানো হয়। উপবৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। শিক্ষকদের বেতন দেয় সরকার।
কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে সাধারণত রাজধানীর মানুষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করান না। এমনকি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের সন্তানেরাও পড়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দৃশ্যমান। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শহর এলাকায় কিন্ডারগার্টেনের ছড়াছড়ি। ইদানীং গ্রামাঞ্চলেও বেড়েছে এই বিদ্যালয়।
শিক্ষা বাণিজ্যের কারণে শহর কি গ্রাম, গড়ে উঠেছে এসব বেসরকারি স্কুল। কোচিং ধাঁচের ব্যবসানির্ভর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতান্তই পণ্য।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের একটি পরিকল্পনা আছে ১০ বছর ধরে অতি নগণ্য শিক্ষার্থী নিয়ে চলা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে পাশের অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার।
ইতিমধ্যে এ ধরনের ৩০০-এর মতো বিদ্যালয়ের তালিকা করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে স্থানীয় বাস্তবতার নিরিখে একীভূত করার কাজ করা হবে।
মন্তব্য করুন