মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: ৩০ জুলাই, ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

পানি সংকটে ভোগে সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষ

পানি সংকট নিয়ে জাতিসংঘের সতর্কতা, কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পানির সংকট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বে ক্রমেই কমে আসছে সুপেয় পানির উৎস। যতই দিন যাচ্ছে এ সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে বহু নদ-নদী। পানি নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে বহু রাষ্ট্র। বিশুদ্ধ পানির সংকট একটি উদীয়মান বৈশ্বিক সমস্যা। যা প্রভাবিত করে সারা বিশ্বের প্রায় ৭৮৫ মিলিয়ন মানুষকে। এর মধ্যে ১.১ বিলিয়ন লোকের পানির অভাব রয়েছে। আর ২.৭ বিলিয়ন মানুষ বছরে অন্তত এক মাস পানির অভাব অনুভব করে। ২.৪ বিলিয়ন মানুষ দূষিত পানি এবং দুর্বল স্যানিটেশনের শিকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এ সংকট। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পানির সংকটের মধ্যে রয়েছে। আর সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করা হয়। বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ‘আসন্ন ঝুঁকি’ রয়েছে পানি সংকটের। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভ্যাম্পায়ারের মতো পানির ব্যবহার এবং লাগামহীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে’র জেরে বিশ্ব এখন ‘অন্ধভাবে এক বিপজ্জনক পথে হাঁটছে।’

বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। জীবনের অধিকার মানে পানির অধিকার। পানি থাকলেই জীবন থাকবে। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানির অভাব এখানে ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। পৃথিবীতে যত মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে। পানিবাহিত রোগের প্রভাবে মৃত্যুর পরিমাণ এখনো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করে হাজারো মানুষ। এদের অধিকাংশই আবার শিশু।

এক পরিসংখ্যান বলছে, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৪০০ শিশুর মৃত্যু ঘটছে। অন্য পরিসংখ্যান বলছে, এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার হবে। তার মানে শিশুরাও পানি সংকটের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখনো এ অধিকার থেকে বঞ্চিত ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই সুপেয় পানির অধিকার রক্ষা করা আজ জরুরি। না হলে সংকটাপন্ন এলাকাগুলো আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আবার চরম দরিদ্র। প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস করে গ্রামে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এশিয়া ও আফ্রিকার সংকট আরও ভয়াবহ।

ইউনিসেফের এক জড়িপ বলছে, চীনের ১০ কোটি ৮০ লাখ; ভারতের ৯ কোটি ৯০ লাখ ও নাইজেরিয়ার ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে ইথিওপিয়ায় ৪ কোটি ৩০ লাখ; ইন্দোনেশিয়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ ও পাকিস্তানে ১ কোটি ৬০ লাখ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশেও আছে চরম সংকট। এখানে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী পানি সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করে। অঞ্চলভেদে পানি প্রাপ্যতার মধ্যে একটি বড় ব্যবধান আছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। এটি দূর করতে চায় জাতিসংঘ।

এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিশুদ্ধ পানিও নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ। এসব লক্ষ্যপূরণে বছরে ৬০০ বিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হতে পারে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান প্রতিবেদনের প্রধান সম্পাদক রিচার্ড কনোর। বর্তমানে বিশ্বে মোট পানি ব্যবহারের ৭০ শতাংশ কৃষি খাতে হচ্ছে। প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মধ্য আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ অ্যামেরিকার কিছু অঞ্চলে বছরের একটা সময় যে পানির অভাব দেখা দেয়, সেটা আরও বাড়বে। আর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে যে পানির সংকট রয়েছে, সেটাও আরও বাড়বে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। গরম বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তীব্র হচ্ছে নিরাপদ খাওয়ার পানির সংকট। শহরে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ওয়াসার গাড়ি থেকে পানি নিচ্ছে মানুষ। এই চিত্র এখন ঢাকার অনেক এলাকায়ই। গরম যত বাড়তে থাকে এই সংকট ততটাই বাড়তে থাকে। শহরের মতোই পানির প্রকট সমস্যা দেখা যাচ্ছে এখন গ্রামেও।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বিশুদ্ধ পানির প্রকট সংকট। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা আশপাশের পুকুর থেকে খাবার পানিসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি সংগ্রহ করেন।

উল্লেখ্য, উপকূলের কাছাকাছি হওয়ায় ওই অঞ্চলের নলকূপের পানিসহ সব উৎসের পানিই লবণাক্ত। সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশনের পর্যাপ্ততা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু সূচক নির্দিষ্ট করেছে জাতিসংঘ। এর মধ্যে রয়েছে সবার জন্য নিরাপদ ও সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন নিশ্চিত করা, পানির দূষণ কমানো, পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, গুণমান উন্নত করা, ঘাটতি মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে পানি ব্যবহার করা, খাল-বিল, নদী, ঝরনা বা হ্রদের মতো পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া, পানি সংগ্রহ ও বিশুদ্ধ করা এবং দক্ষতার সঙ্গে পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর মতো আরও নানা বিষয়।

ইউএন ওয়াটারের ২০২২ সালের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাত্র ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ উৎস থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছেন, যা ২০০৮ সালে ছিল ৫৫ শতাংশ। একই সঙ্গে, উন্নত স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ রয়েছেন, ২০০৮ সালে এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৫৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকার আগামী ১০০ বছরের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কৌশলের রূপরেখা হিসেবে বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০ (বিডিপি ২১০০) গ্রহণ করেছে। অভিযোজিত কৌশল বাস্তবায়ন করা ও দীর্ঘ মেয়াদে বিস্তৃত পানি সম্পদ খাতজুড়ে প্রশাসনকে শক্তিশালী করাই হলো এই বিডিপি ২১০০-এর লক্ষ্য। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে নারী, শিশু ও সুবিধাবঞ্চিতদের ওয়াশ সুবিধার আওতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সহযোগী উন্নয়ন সংস্থাগুলো। যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সিলেটের ২১টি চা বাগানে সুপেয় পানি ও উপযুক্ত টয়লেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওয়াটারএইড। ‘মিউনিসিপ্যাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট-২০১৯’ এর মাধ্যমে প্রায় ৬ লাখ মানুষের সুবিধার্থে এগিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাংক।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে টয়লেট নির্মাণে সহযোগিতা করেছে ইউনিসেফ, ইউকেএইড ও দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)। বস্তিতে এডিবির (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) অর্থায়নে পানির সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে ঢাকা ওয়াসা। পাশাপাশি, সরকারের ‘কমিউনিটি-লেড টোটাল স্যানিটেশন’ উদ্যোগ প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ওয়াটারএইড। একই সঙ্গে, ‘সেইফ ওয়াটার ফর অল’ প্রকল্প গ্রহণ করে ব্র্যাক এবং সাজিদা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পরিচালিত হয় স্থানীয় ক্লিনিকে পরিচ্ছন্ন পানি নিশ্চিতে কমিউনিটিকেন্দ্রিক প্রকল্প।

ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। অথচ ধান-নদী-খালের দেশে বাংলাদেশ। কিন্তু মানুষের বিভিন্ন পরিবেশ বিপন্নকারী কাজের ফলে সব আজ মরতে বসেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলছেন, টেকসই নয় এমনভাবে জলের ব্যবহার, দূষণ এবং লাগামহীন উষ্ণায়নের জেরে পানি, যা কিনা ‘বিশ্ব মানবতার প্রাণশক্তি,’ তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ইউএন ওয়াটার অ্যান্ড ইউনেস্কোর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ব্যবহার এবং দূষণের কারণে পানির ‘দুষ্প্রাপ্যতা প্রকট হয়ে উঠছে।’ অন্যদিকে, বিশ্বের উষ্ণায়ণের ফলে যেখানে প্রচুর জল পাওয়া যায় এবং যেখানে জল সংকট রয়েছে, এই দুই জায়গাতেই কোনো কোনো মৌসুমে পানির ঘাটতি বেড়ে যাবে।


সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ

 

মন্তব্য করুন