
প্রকাশিত: ৮ ঘন্টা আগে, ১০:২৯ এ এম
অনলাইন সংস্করণ
মেহেদী হাসান:
ইন্সপেকশন এজেন্ট বা মান যাচাইকারী কোম্পানিগুলোকে ম্যানেজ করে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছাপিয়ে ৩৫৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এক শ্রেণির ছাপাখানা।
এ পর্যন্ত এমন ১৭টি ছাপাখানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেগুলোর মালিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি।
তাদের বিল আটকে দেওয়াসহ কালো তালিকাভুক্ত করার চিন্তাভাবনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র ইত্তেফাককে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটির বেশি বই সারা দেশে বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু দরপত্রের স্পেসিফিকেশন (নির্ধারিত মান) অনুযায়ী ছাপানো হয়নি এমন অভিযোগে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে সরকার।
(এনসিটিবি) নেতৃত্বে দুটি পরিদর্শন সংস্থা ও দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ৩২টি দল ৬৪ জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে। এতে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৮ কোটির বেশি নিম্নমানের কাগজে ছাপা বলে শনাক্ত হয়েছে।
টেন্ডারের সব শর্ত মেনে পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি নিলেও কাগজের পুরুত্ব (মোটা), ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) ও টেকসই ক্ষমতা (বার্স্টিং ফ্যাক্টর) কিছুই মানা হয়নি।
জানা গেছে, এনসিটিবি বেসরকারি ‘তৃতীয় পক্ষের’ মাধ্যমে পরিদর্শন করালেও প্রতিবারই পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে বিতর্ক উঠছে। মূলত গত ১৬ বছর ধরে ছাপাখানাগুলোর ছায়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে করেছে ইন্সপেকশন এজেন্ট কোম্পানিগুলো।
বইয়ের উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই)। অন্যদিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহের পর, ঐসব বইয়ের মান যাচাইয়ের তদারকি করে পিএলআই এজেন্ট।
প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের পিডিআই ও পিএলআই ইন্সপেকশনের কাজ একই কোম্পানি করলেও মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশনের কাজ দুটি আলাদা কোম্পানিকে দেওয়া হয়। পিডিআই ও পিএলআই ইন্সপেকশন কোম্পানিগুলো কাজ পাওয়ার জন্য টেন্ডারে অংশ নেয়, যা খরচ হয় তার অর্ধেক টাকায়।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গত ফেব্রুয়ারি মাসে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ইত্তেফাককে বলেন, ‘মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনা পয়সাও ইন্সপেকশন করতে চান।
’ অভিযোগ আছে, প্রতিটি ইন্সপেকশন কোম্পানি ছাপাখানার মালিকদের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নেন। এ কারণে তারা সব পজিটিভ রিপোর্ট দেন। বই ছাপার আগে তিন স্তরে তদারকির কথা পরিদর্শন এজেন্সির। প্রথমে প্রেসে কাগজের মান (স্থায়িত্ব ও জিএসএম) ঠিক আছে কি না, তা দেখে ছাড়পত্র দেবে, ছাপা ও ডেলিভারির আগে বইয়ের মান দেখে ছাড়পত্র দেবে। এই স্তরকে পিডিআই বলে।
এজন্য গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য প্রেসে প্রেসে ২৪ ঘণ্টার তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ১১৫ ছাপাখানা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের জন্য প্রত্যেকটি ইন্সপেকশন কোম্পানির জনবল আছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন করে। তাও আবার অদক্ষ।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসে ৮ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দিয়ে ছাপাখানা মনিটরিংয়ে পাঠানো হয়। যাদের কাগজের মান যাচাইয়ের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। ইন্সপেক্টরদের থাকা, খাওয়া ও বেতন ছাপাখানাগুলোর মালিক বহন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে এক শে্রিণর ছাপাখানার মালিক নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর সুযোগ পান।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেন, চলতি বছর বইয়ের মান ঠিক রাখতে তিনটা পরিদর্শন এজেন্সি ছাড়াও এনসিটিবির কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন। এত তদারকির পরও নিম্নমানের বই গেছে স্কুলে। নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রাথমিকের বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে কাগজের পুরুত্ব ও ব্রাইটনেস মানা হলেও প্রাথমিকের অনেক বইয়ে বার্স্টিং ফ্যাক্টর মানা হয়নি।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের বই বেশি নিম্নমানের। কাগজের পুরুত্ব, ব্রাইটনেস ও বার্স্টিং ফ্যাক্টর কোনোটাই মানেনি। ছাপাখানার মালিকরা প্রতিবারের মতো এবারও কৌশলে জেলা সদর ও উপজেলা শহর ছাড়া মফস্বল এলাকায় নিম্নমানের বই দিয়েছে।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এবার জেলা সদর ও উপজেলা সদর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি। সারা দেশের মফস্বল এরিয়া থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, এতে বেশি নিম্নমানের বই শনাক্ত হয়েছে।
এবার এনসিটিবির মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের পিডিআই এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে ‘ব্যুরো ভ্যারিটাস’। প্রাথমিক স্তরের বইয়ের পিডিআই ও পিএলআই এজেন্ট কোম্পানি হলো ‘ফিনিক্স’।
ব্যুরো ভ্যারিটাস নামক কোম্পানি এবারই প্রথম মাত্র ৩২ লাখ টাকাতে মাধ্যমিকের কাজ করে, যা গত ১০ বছরে এত কম মূল্যে কেউ করেনি। প্রায় সব মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানই লো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে কাজ পাওয়ার জন্য। পরবর্তীতে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।
অন্যদিকে বই ছাপার পর মান যাচাইয়ের জন্য হাইটেক সার্ভে বিডি নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঐ প্রতিষ্ঠানটিও মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করাচ্ছে।
হাইটেক সার্ভে বিডির স্বত্ব্বাধিকার মো. বিপ্লব গণমাধ্যমকে বলেন, সারা দেশে নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। নিম্নমানের পাঠ্যবই সরবরাহ করেছে এমন ১৭টি ছাপাখানা ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কাছে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, বইয়ে ভুলত্রুটি হলে সেটির দায় ইন্সপেকশন কোম্পানির। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের এত সংস্থা ও এজেন্সির তদারকির পরও নিম্নমানের বই সরবরাহ হওয়ার মানে বুঝতে হবে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ আছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন