চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪ মার্চ, ২০২৪, ০১:১৫ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

সংগ্রামী নারী কোকিলা

মাজেদা খাতুন কোকিলা। ছবি রূপালী বাংলাদেশ

বয়স সবে মাত্র ১১ বছরে পা দিয়েছে। যে বয়সে খেলাধূলা আর পড়া লেখায় ব্যস্ত সময় পার করার, সে সময় বিয়ে পিড়িতে বসতে হয় মাজেদা খাতুন কোকিলার। বিয়ের দু বছর পরেই কোকিলার ঘর আলো করে আসে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। ছেলের নাম রাখেন মাজেদুল ইসলাম সুইট। ছেলের বয়স যখন মাত্র দুই বছর আর কোকিলার বয়স ১৫ বছর। সে সময় কোকিলা দেখতে সুন্দর না, উচ্চতায় ছোট এবং পড়া-লেখা জানে না এ অপবাদ দিয়ে কোকিলার স্বামী কোকিলা আর তার সন্তানকে ছেড়ে চলে যাই। মাজেদা খাতুন কোকিলা যেন অথৈই সাগরে পড়ে যাই ছেলেকে নিয়ে। কি করবে ছেলেকে নিয়ে, আর কোথায়ই বা যাবে? চিন্তার শেষ নেই! শুরু হয় কোকিলার সংগ্রামী জীবন।

মাজেদা খাতুন কোকিলা জানান, ছেলেকে বড় করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যয় নিয়ে অন্যের বাড়ি কাজ করে শুরু করেন। শুধু অন্যের বাড়িতে কাজ করেই বসে থাকেননি। রাতের বেলায় ছেলেকে পাশে বসিয়ে পড়া-লেখা আর নিজে সেলাইয়ের কাজ করতেন। এমনও দিন গেছে ছেলেকে জামা কিনে দিতে পারেনি, নিজের ওড়না দিয়ে জামা তৈরি করে দিয়েছেন। সেই জামা পরেই ছেলের কেটেছে অনেকদিন। এমনও রাত গেছে অন্যের বাড়িতে থাকার কারনে রাতে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিত বাড়ির মালিক। ছেলে আলো ছাড়া পড়া-লেখা করতে পারতো না। এ কারনে রাতে ছেলেকে সড়কের ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসিয়েই পড়া-লেখা করতো কোকিলা। 

তিনি আরো জানান, অন্যের বাড়িতে এবং নিজে হাতের কাজ করে ছেলেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করান কৃতিত্বের সাথে। ছেলে সুইট ও ছিল দুর্দান্ত মেধাবী। মায়ের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে কোন বাধাই তাকে দমাতে পারেনি। ছেলে এইচএসসি পাশ করার পরে আলমডাঙ্গা পৌরসভায় (অস্থায়ী ভাবে) অফিস সহকারী হিসাবে চাকুরী দেন তৎকালীন মেয়র সবেদ আলী। পরবর্তিতে সেই চাকুরি স্থায়ীও করে দেন তৎকালীন মেয়র। 

মাজেদা খাতুন কোকিলা জানান, এইচএসসিতে আর্থিক সামর্থ না থাকার কারনে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে পারেনি ছেলেকে। বাধ্য হয়েই মানবিকে পড়াতে হয়। এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখে ছেলে সুইট। মায়ের ইচ্ছায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়। পরবর্তিতে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে শিক্ষক হিসাবেও একই বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বর্তমানে কোকিলার ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক এবং সরকারী স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চতর ডিগ্রী (পিএইচডি) তে অধ্যায়নরত রয়েছে। ছেলে মাজেদুল ইসলাম সুইট মা কোকিলাকে নিয়ে ইতিমধ্যে অষ্ট্রেলিয়ায় ৯ মাস রেখেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে-বউ ও নাতি নাতনিদের সাথে কাটানো মজার স্মৃতি স্মরণ করেন। কোকিলা ছেলে-বউমার আদরের প্রশংসা করলেন অকপটে । 

প্রতিবেশী ও সহকর্মিরা জানান, কোকিলা এই সামজকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারীরা ইচ্ছে করলেই সব করতে পারে। কারন যে বয়সে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে সেই বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু সন্তানের কথা মনে করে, স্বামীর সেই কটু কথার জবাব দিতেই হাজারও কষ্ট মেনে নিয়ে ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলেছেন।

আলমডাঙ্গা পৌর সভার মেয়র হাসান কাদির গনু বলেন, কোকিলার মতো নারী এই সমাজের উজ্জল দৃষ্টান্ত। যে কিনা হাজারো কষ্টের পরেও ইচ্ছা শক্তির কারনে আজ তার ছেলে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ার উচ্চতর ডিগ্রী নিতে সেখানে অবস্থা করছেন।  

কোকিলা ইতিমধ্যে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে বিশ্ব মা দিবসে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে “স্বপ্নজয়ী মা” সম্মাননা, ২০১৭-১৮ সালে খুলনা বিভাগের মধ্যে ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা, ২০১৭ সালে সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে চুয়াডাঙ্গা জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা সহ জেলা উপজেলা পর্যায় থেকে বহু সম্মাননা পেয়েছেন মাজেদা খাতুন কোকিলা।     

ছেলেকে পড়া-লেখা করার কারনে সামাজের কাছ থেকে এই কোকিলাকে শুনতে হয়েছিল অনেক কটু কথা। অনেকেই বলতো ছেলে পড়িয়ে জজ-ব্যারিষ্টার বানাবে? ছেলে জজ-ব্যারিস্টার না হলে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একই বিভাগের শিক্ষক হয়েছেন। তিনি এ সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীরা ইচ্ছে করলেই সব পারে । যার জলন্ত উদাহরণ মাজেদা খাতুন কোকিলা। 

মন্তব্য করুন