প্রকাশিত: ১৮ ঘন্টা আগে, ০৯:৫৮ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

জুলাই সনদ সই হচ্ছে না আজ

 

সদরুল আইনঃ

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে অন্যতম আলোচ্য ‘জুলাই সনদ’ চলতি মাসের মধ্যেই প্রণয়ন ও তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার আশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। 

আজ বৃহস্পতিবার জুলাইয়ের শেষ দিন। ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে এতদিন সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় এবং অন্তত আটটি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে এখনো মতৈক্য না হওয়ায় এ মাসে তাতে সই করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ছয় মাসের জন্য গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর মেয়াদ আজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর মেয়াদ বাড়ছে। আগের খসড়া নিয়ে প্রধানত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এনসিপির মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় আজ একটি ‘সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য’ খসড়া দলগুলোকে সরবরাহ করবে কমিশন।

 সবমিলিয়ে সৃষ্ট এক ধরনের সংশয়ের মধ্যেই আজ সকাল সাড়ে ১০টায় দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসছে ঐকমত্য কমিশন।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, আশা করছি আগামীকাল (আজ) আমরা একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দিতে পারব। 

ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, সেটির একটি তালিকা গতকালই দলগুলোকে দিয়েছে কমিশন। খসড়ার বিষয়ে দলগুলোর কোনো পরামর্শ-আপত্তি থাকলে তা আজকের মধ্যে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই এবং আলোচনা শেষ করতে চাই।

প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়।

 পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে ঐকমত্য কমিশন।

 এর মধ্যে আইন-বিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব এমন অনেকগুলো সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

অন্যদিকে, ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯মে) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি—এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন।

 সে আলোচনা এখনো চলমান। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ৩২টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

যে ১২ বিষয়ে ঐকমত্য:

ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমঝোতা হয়েছে, সেটির একটি তালিকা গতকাল দলগুলোকে দিয়েছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, ‘বিষয়ে মতভিন্নতা ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের, সেগুলোর ওপর গত চার মাস ধরে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করেছে। 

১৯টি বৈঠক শেষে ১২টি বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানো গিয়েছে। এই ১২টি বিষয় হলো—প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ইসির গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার।

যে আটটি বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি:

দুই ধাপে ধারাবাহিক সংলাপ করেও আটটি মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে দলগুলোর সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। এগুলো হলো—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ চারটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। এছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রশ্নে একমত হতে পারেনি দলগুলো।

গতকাল আলোচনার শুরুতে আলোচনার গতি বাড়াতে দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করে আলী রীয়াজ বলেন,  যেমনটি আপনারা শুরু থেকেই করে আসছেন, তেমন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা আমরা আশা করছি। 

আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি, এসব বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে এবং আগামীকালের (আজ) মধ্যেই আপনাদের অবহিত করতে পারব।

সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি লিখিত খসড়া অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে তুলে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে সব দল মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের নীতিগত অবস্থানে একমত হয়েছে। তবে, সংবিধানে এ বিষয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এবং তা আলোচনাকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তাব এখনো প্রস্তুত না হলেও অন্য বিষয়গুলোয় দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চলছে বলে আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গতকাল বৈঠকের শুরুতে স্ক্রিনে সাতটি আলোচ্য বিষয় দেখানো হয়। আলোচ্যসূচিতে রাখা বিষয়গুলো হলো—সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান-সম্পর্কিত; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এক্তিয়ার ইত্যাদি; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব ও রাষ্ট্রের মূলনীতি।

তবে, বেলা ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত শুধু নারী আসন নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এরপর বিরতি দিয়ে রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আবার আলোচনা হয়। তবে, সাতটির একটিতেও ঐকমত্য হয়নি।

 জানা গেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আলোচনায় বিরতি দিয়ে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখান থেকে এসে আবারও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

দলগুলো যা বলল:

গতকালের সংলাপেও বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকিগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। এরপরেও নির্বাচিত সরকার এলে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এর দায়িত্ব আগামী সংসদের ওপর দেওয়া অর্থহীন। অনেকে বলছেন, আইনি ভিত্তির সম্ভাবনা নেই। আমরা বলব, তাহলে এর দরকার নেই।

 তিনি বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে এতদিনের বৈঠক খাওয়াদাওয়া, আর আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে বলছেন—অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি ঠিক নয়। 

কারণ তিনটি পদ্ধতিতে দেওয়া যায়। এক লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, গণভোট ও রেফারেন্ডাম। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে গণভোটে অনেক কিছুই সমাধান হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এনিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। 

এর ব্যত্যয় হলে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে ঐকবদ্ধভাবে আদায় করা হবে। আর ঐকমত্য কমিশনের একমত হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে জুলাই সনদও হতে হবে আইনিভাবে।

মন্তব্য করুন